বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের কোটা আন্দোলন সরকার পতনের এক দফা দাবিতে রুপ নিলে তা নস্যাৎ করতে নানা ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) প্রশাসন, আওয়ামীপন্থী সংগঠন বঙ্গবন্ধু পরিষদ ও শাপলা ফোরাম। আন্দোলন বিরোধিতা ও দমনে তারা দফায় দফায় মিটিং করে নানা কূটকৌশল প্রণয়ন করে। ধীরে ধীরে বের হয়ে আসছে সে সকল তথ্য।
সূত্রমতে, ব্যক্তিগতভাবে টিভি টকশো, অনলাইন প্রচারণা ও শিক্ষার্থীদের হুমকির পাশাপাশি ক্যাম্পাসে জঙ্গি কায়দায় মিছিল-সমাবেশ, ঢাকায় ও গোয়েন্দাদের কাছে ছাত্র আন্দোলনের পক্ষের শিক্ষকদের তালিকা প্রেরণসহ নানা ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেন আওয়ামী পন্থী শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের একাংশ। এছাড়া ছাত্রলীগের মাধ্যমে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হুমকির মধ্যে রাখা হয়।
৩ আগস্ট সকালে ভিসি কার্যালয়ে আন্দোলন দমন বৈঠকে বসেন আওয়ামীপন্থী শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা, সেখানে উপস্থিত কয়েকজনের সূত্রে বিষয়টি জানা গেছে। বৈঠক শেষে আরো সংগঠিত হয়ে ছাত্র আন্দোলন ও তাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশকারী শিক্ষকদের মিছিলে হামলার জন্য উদ্যত হন শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।
সূত্র জানায়, এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী ভূমিকা পালন করেন ড. বাকী বিল্লাহ বিকুল, ড. মিয়া রশিদুজ্জামান, ড. মাহবুবুল আরেফীন, কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন খান, আব্দুস সালাম সেলিমসহ আরো অনেকে। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটে চলতে থাকা শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ কেন বন্ধ হলো এ বিষয়ে প্রক্টরিয়াল বডিকে তারা চাপ দিতে থাকেন। পরে সহকারী প্রক্টর ড. আমজাদ হোসেন সহ প্রক্টরিয়াল বডির অন্যান্য সদস্যরা বেশ কয়েকবার মাইক্রোতে করে সমাবেশের পাশ দিয়ে ঘোরা ফেরা করেন। এছাড়া, দায়িত্বরত পুলিশদের সমাবেশ পন্ড করে দেবার জন্য নির্দেশনা দেন বলে জানা গেছে। এছাড়াও কুষ্টিয়া শহরে একজন গুলিবিদ্ধ হন, এইখানে তাদের ইন্ধন রয়েছে বলেও জানা গেছে।
এদিকে ৪ আগস্ট সকালে বিপুলসংখ্যক আওয়ামীপন্থী শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ক্যাম্পাসে এসেই ভিসির বাংলোতে মিটিংয়ে বসেন এবং ছাত্রদের আন্দোলনকে দমন করার বিষয়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। তারই অংশ হিসেবে ছাত্র আন্দোলনকে নৈরাজ্য দাবি করে ভিসির বাংলোর সামনে থেকে সাবেক প্রক্টর ড. মাহবুবর রহমানের নেতৃত্বে একটি প্রতিবাদ মিছিল শুরু হয়। প্রাপ্ত ভিডিও মোতাবেক, মিছিলটি সাইন্স ফ্যাকাল্টির সামনে আসলে ড. মাহবুবুল আরেফিন, শহীদুল ইসলামসহ অন্যান্যরা 'আর নয় হেলাফেলা, এবার হবে ফাইনাল খেলা' সহ বিভিন্ন উগ্র স্লোগান দিতে থাকে। এক পর্যায়ে মিছিলটি অনুষদ ভবনের সামনে এসে সমাবেশে মিলিত হয়। সেখানেও বক্তারা উগ্র ভাষায় ছাত্রদের আন্দোলন প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়।
পরে বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের একটি মিছিল হলের দিকে থেকে ডায়না চত্বরের দিকে অগ্রসর হয়। সূত্র জানায়, এতে ক্ষিপ্ত হয়ে মিছিলে হামলার লক্ষ্যে উদ্যত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা আব্দুল হান্নান, ইব্রাহিম হোসেন সোনা, আব্দুস সালাম সেলিমসহ কয়েকজন কর্মকর্তা। পরবর্তীতে ছাত্র জনতার মিছিলে ব্যপক উপস্থিতি দেখে তারা ভয়ে পালিয়ে যায়।
এছাড়াও ছাত্র আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশকারী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার জন্য কেন্দ্রীয় নির্দেশনার আলোকে ৪ আগস্ট তালিকা তৈরি করে তারা ঢাকায় পাঠিয়ে দেন বলে জানিয়েছে সূত্রটি। পাশাপাশি অন্যান্য সংস্থাও তালিকা পাঠায়। এছাড়া, একই দিনে ঢাকায় সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্দোলন দমনে প্রধানমন্ত্রীর ডাকা সমাবেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. আনোয়ার হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক ড. মামুনুর রহমানের নেতৃত্বে ঢাকায় গমন করে একটি প্রতিনিধি দল।
আওয়ামীপন্থী ও গোয়েন্দাদের পাঠানো ছাত্র আন্দোলনের পক্ষের তালিকায় পাওয়া নামের মধ্যে রয়েছে বিএনপিপন্থী শিক্ষক ড. এমতাজ হোসেন, ড. তোজাম্মেল হোসেন, ড. মতিনুর রহমান, ড. নজিবুল হক, ড. সিদ্দিকুর রহমান আশ্রাফী, ড. শাহিনুজ্জামান, ড. কাজী মোস্তফা আরিফ, ড. মুন্সী মোর্তজা, ড. আব্দুস সবুর, মোহাম্মদ সেলিম, ড. আব্দিস শাহিদ মিয়া, ড. মনজুরুল হক, ড. আ.হ.ম নুরুল ইসলাম, ড মোঃ রশিদুজ্জামান, ড মোঃ রফিকুল ইসলাম এবং ড. শেখ এ বি এম জাকির হোসেন।
এছাড়া তালিকায় থাকা জামায়াতপন্থী শিক্ষকরা হলেন, ড মোঃ মাহবুবুর রহমান, ড. মোঃ আব্দুল বারী, ড. মোঃ অলী উল্যাহ, ড. লুৎফর রহমান, ড. মোঃ নাছির উদ্দিন মিঝি, ড. মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান, ড. আকতার হোসেন, ড. একে এম মফিজুল ইসলাম, ড. কামরুল হাসান, ড মোঃ মিজানুর রহমান, ড. আসাদ-উদ-দৌলা বুলবুল ও ড. শামছুল হক সিদ্দিকী।
এছাড়া ২৯ জুলাই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসনের সহযোগীতায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক ডেকে এনে আন্দোলন প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। সামগ্রিক প্রক্রিয়ায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তৎকালীন ভিসি, প্রো-ভিসি, ট্রেজারার, প্রক্টর, ছাত্র উপদেষ্টা, বিভিন্ন বিভাগীয় সভাপতি, সাবেক প্রক্টর ড. মাহবুবুর রহমান ও ড. মাহবুবুল আরেফীন সহ বঙ্গবন্ধু ও শাপলা ফোরামের নেতৃবৃন্দ। সে সময়ে আন্দোলন প্রত্যাহারকারী শিক্ষার্থীরা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।